সুনামগঞ্জ শহরের শৃঙ্খলার জন্য
- আপলোড সময় : ১৫-০৪-২০২৫ ১১:০৭:৩৬ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৫-০৪-২০২৫ ১১:০৭:৩৬ অপরাহ্ন

মোহাম্মদ আব্দুল হক
এক সময়কার মেঠোপথের গ্রাম প্রধান আমাদের দেশটা এখন ছোটো মাঝারি ও বড়ো শহরের বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে। শহরের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হলো বালি পাথর রড সিমেন্টের পাকা সড়ক থাকবে, সড়কে ছোটো মাঝারি ও বড়ো আকৃতির ও নানান গতির যানবাহন চলবে আর সড়কের উভয় পাশে পথচারীদের পায়ে চলাচলের জন্য সড়ক থেকে কিছুটা উঁচু এবং ন্যূনতম দুইজন মানুষ পাশাপাশি হাঁটতে পারার মতো প্রশস্থ ফুটপাত থাকবে। এছাড়াও ফুটপাতে চলাচলকারী মানুষের রাস্তা পারাপারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় নির্দিষ্ট স্থানে স্থানে জেব্রা ক্রসিং থাকবে। সড়কের পাশে ডাস্টবিন ও ড্রেন থাকবে পরিকল্পিতভাবে। গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম এলাকার গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে রাস্তার যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণের কথা মাথায় রেখে শহরের প্রধান সড়কে থাকবে স্পিড ব্রেকার। আরও আছে ফুটওভার ব্রিজ এবং ট্রাফিক সিগন্যাল।
আমাদের বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় এবং বিভাগীয় বড়ো শহরে ও জেলা শহরে উপর্যুক্ত বিষয়গুলোর গুরুত্ব অধিক এবং সেই অনুযায়ী সড়কের পাশাপাশি ফুটপাত, স্পিড ব্রেকার, জেব্রা ক্রসিং এবং ট্রাফিক সিগন্যাল ও ফুটওভার ব্রিজ কমবেশি প্রায় সব শহরেই দেখতে পাওয়া যায়। তবে কোনো কোনো শহরে তা অপ্রতুল। অথচ শহর ও নগরের শৃঙ্খলা বিধানের জন্য এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই সাথে গাড়ি চালক ও পথচারীদেরও এসব বিষয়ে উপযুক্ত জ্ঞান ও সচেতনতা দরকার। এখন আমরা আমাদের ছোটো জেলা শহরের দিকে মনোযোগ দিলে কি দেখতে পাই সেই নিয়ে এই লেখা।
জেলার সবচেয়ে বড়ো শহর হচ্ছে সুনামগঞ্জ পৌরসভা শহর। এটি একটি প্রাচীন শহর এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও রাজনৈতিক দিক বিবেচনায় সুনামগঞ্জ সম্প্রীতির শহর। এই শহর গড়ে উঠেছে সুরমা নদীর তীরে এবং হাওরের কোলে। এখানে শত বছরের পুরোনো সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়সহ অনেক স্কুল কলেজের অবস্থান রয়েছে। সুনামগঞ্জে এখন প্রতিদিন বাস, ট্রাক, লঞ্চ ও নৌকায় চড়ে হাজার মানুষ ও পণ্যের আসা-যাওয়া চলে। পর্যটন শিল্পের জন্য এই শহরের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশি। সুনামগঞ্জ শহরের সাথে রয়েছে রাজধানী ঢাকার সরাসরি বাস যোগাযোগ। প্রতিদিন বহু সংখ্যক বাস যাত্রী নিয়ে ঢাকায় আসা-যাওয়া করে। স্বাভাবিক কারণেই বহু রকম মানুষের থাকা-খাওয়ার জন্য দিনে দিনে সুনামগঞ্জে গড়ে উঠেছে সাধারণ মানের পাশাপাশি মাঝারি মানের বেশকিছু হোটেল এবং ভালো ভালো খাবারের রেস্টুরেন্ট আছে অনেক। সেই সাথে আধুনিক সব শপিং মলেরও উপস্থিতি লক্ষণীয়। এই-যে এতোকিছু তা কিন্তু এমনি এমনি গড়ে উঠেনি। এসব কিছুই সুনামগঞ্জের স্থায়ীভাবে বসবাসকারী মানুষ এবং বিভিন্ন সরকারি কাজে আসা, ব্যবসার কাজে আসা ও বেড়াতে আসা মানুষের চাহিদা মিটিয়ে চলছে প্রতিনিয়ত। সে হিসেবে ছোট্ট সুনামগঞ্জ শহরে প্রতিদিন কয়েক শতো ছোটো বড়ো পরিবহন প্রবেশ করতে হচ্ছে এবং কয়েক হাজার মানুষের আসা-যাওয়া চলে। আর শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা বিদ্যালয় ও সরকারি-বেসরকারি অফিসে প্রতিদিন নিয়ম করে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর সাথে বিভিন্ন পেশাজীবীদের চলাচল অব্যাহত। এমন অবস্থায় নিশ্চয়ই আমাদের পরিবহন ও সড়কের নিরাপত্তার বিষয়টি সবার আগে চলে আসে। আমরা এই শহরের প্রধান প্রধান সড়কে প্রতিদিন কি দেখতে পাচ্ছি- এই শহরে কোর্ট পয়েন্ট এলাকার সামনে থেকে ব্যস্ততম পুরাতন বাসস্ট্যান্ড হয়ে মধ্যবাজার পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশের এমন কোনো ফুটপাত নেই যেখানে স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী এবং সাধারণ মানুষ নির্বিঘেœ হেঁটে চলাচল করবে। যা-ও অল্প কিছু ফুটপাত বিগত বছরগুলোতে হয়েছিল তা সবই দখল হয়ে গেছে এবং সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দখল হয়ে থাকে হরেকরকম ব্যবসা পণ্যের দোকানে। শহরের আলফাত উদ্দিন স্কয়ার (যা ট্রাফিক পয়েন্ট নামে পরিচিত) থেকে উকিলপাড়া পয়েন্ট হয়ে যে সড়ক গেছে ষোলোঘর পয়েন্ট পর্যন্ত সেখানে দৃশ্যমান ফুটপাত নেই এবং সড়ক ভাঙাচোরা। মূলত এতোটুকুকে বলা যায় সুনামগঞ্জের প্রধান সড়ক যে পথে প্রতিদিন হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বহু পেশার মানুষের চলাচল। শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর বেহাল চেহারা দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না সুনামগঞ্জে অন্য মহল্লার ও পয়েন্টের সড়ক ও ফুটপাতের অবস্থা কেমন। অথচ রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে এসব সড়ক ও ফুটপাত তৈরি করা হয়েছে রাষ্ট্রের মানুষের নিরাপদ চলাচলের জন্য। যেখানে সড়ক ও ফুটপাতের এই করুণ হাল সেখানে আমরা কিভাবে আশা করতে পারি যে এই শহরের মানুষ নিশ্চিত হয়ে জেব্রা ক্রসিং পার হবে! অথচ শহরের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যালয়ের সামনে ¯পষ্ট জেব্রা ক্রসিং থাকা খুবই জরুরি। রিকশা বা অটোরিকশায় যাতায়াত করতে গেলে যখন দেখা যায় কোথাও স্পিড ব্রেকার আছে সেখানে আমাদের রিকশা ও অটোরিকশা ড্রাইভার সাহেবরা যেনো আরও বেপরোয়া গতিতে না-চালালে তাদের দক্ষতার পরিচয় ম্লান হয়ে যায়! তখন সহজে বুঝা যায় ড্রাইভারদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। অল্প কয়েকটি ডাস্টবিন থাকা সত্বেও মানুষ বর্জ্য ফেলে দিচ্ছে রাস্তায় না-হয় ড্রেনে। এতে ড্রেনের পানি সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায়। ময়লা পানি রাস্তায় উঠে আসে। মানুষও সচেতন না। মানুষ সচেতন না তাই বলে হাল ছেড়ে দিলে তো হবে না। এসব বিষয়ে সবসময় জনসচেতনতা মূলক প্রচার পত্র বিলিয়ে দিতে হবে এবং স্থানীয় পত্রিকায় সমাজ সচেতনতা বিষয় লেখা প্রকাশ করতে হবে।
সুনামগঞ্জের বহুল প্রচারিত দৈনিক সুনামকণ্ঠে ইতিপূর্বে শহরের সমস্যা ও সমাধান বিষয়ে আমার লেখা প্রকাশ হয়েছে। এ পর্যায়ে সবকিছুর সমাধান কিভাবে হবে তা হয়তো আমার জানা নাই। সড়ক সংস্কার ও বর্ধিত করতে হবে, ফুটপাত, ড্রেন, জেব্রা ক্রসিং, স্পিড ব্রেকার প্রয়োজনীয়। ঘনঘন ফুটপাত দখলমুক্ত করার অভিযান চালানো যেতে পারে। স্পিড ব্রেকার ও জেব্রা ক্রসিং-এ ড্রাইভার নিয়ম মানছে কি-না তা-ও তদারকিতে রাখতে নিয়মিত অভিযান চালানো যেতে পারে। এখানে অবৈধ দোকান ও ফুটপাতে অভিযান হয় কখনও কখনও। আমি বিশ্বাস করতে চাই না যে, হঠাৎ অভিযান চালিয়ে থেমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে লোকদেখানো বা আন্তরিকতার অভাব। হতে পারে আমাদের সকল ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত লোকবলের অভাব রয়েছে, তাই প্রতিনিয়ত সকল সড়কের স্পিড ব্রেকার ও জেব্রা ক্রসিং-এ গাড়ির স্পিড নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে কি-না তা দেখাশুনা করা সম্ভব হয় না। ফুটপাতেও কেউ পণ্য সাজিয়ে দোকান নিয়ে বসেছে না-কি সাইকেল, মোটর সাইকেল এমনকি চার চাকার গাড়ি তোলে রেখেছে তা সার্বক্ষণিক পুরো শহরজুড়ে দেখভাল করার লোকেরও অভাব হয়তো রয়েছে। সেক্ষেত্রে আমাদের অধিক জনসংখ্যার দেশে যেখানে শিক্ষিত ছেলে-মেয়েরা কাজ না-পেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে ছুটছে, সেখানে এসব ক্ষেত্রে আরো অধিক লোক নিয়োগ করলে, দেশে কর্মহীন লোকের সংখ্যাও কমবে এবং পাশাপাশি শহর জীবনে শৃঙ্খলা ফিরবে মনেকরি। এই দিকটি আমাদের সরকার ভেবে দেখতে পারেন। দেখতে পাওয়া যায় বিভিন্ন অফিস ও ভবনের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় বিভিন্ন প্রাইভেট সিকিউরিটি ফোর্সের লোকেরা নিয়োজিত থাকে এবং তারা যথেষ্ট দক্ষতা ও আন্তরিকতার সাথেই দায়িত্ব পালন করে। আমাদের বিভিন্ন টানা ফুটপাতে এমন ফোর্সের সহায়তায় শৃঙ্খলা আনয়ন করা যেতে পারে। আমার এই প্রস্তাবটি পরীক্ষামূলক ভাবে শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কের পাশের ফুটপাতে এবং শহরের কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি জেব্রা ক্রসিং-এ প্রয়োগ করে দেখার জন্যে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করছি। এ ব্যবস্থা কার্যকর করলে সুফল পাওয়া যাবে আমি অনেকটাই নিশ্চিত। এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জসহ সারাদেশে কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
আমি শুধু মন্দ তুলে ধরার জন্য লিখছি না। আমি বলতে চাচ্ছি, এই-যে আমরা আমাদের সুনামগঞ্জ নিয়ে গর্ব করি, বাস্তবে আমরা কি দেখি এবং আমরা কতোটা নাগরিক সুবিধা উপভোগ করতে পারছি তা নিয়ে আমাদেরকে ভাবতে হবে। আমরা সাধারণ মানুষ আশা করছি যেসব বিষয় শহরবাসীর উপকারে আসে সেদিকে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ প্রশাসন মনোযোগ দিবেন। এখানে যে কথাটি চূড়ান্ত পর্যায়ে স্বীকার করতে হবে তা হলো, শুধু নিয়ম অনুযায়ী রাস্তা, ড্রেন, ফুটপাত, ¯িপড ব্রেকার, জেব্রা ক্রসিং এবং স্থানে স্থানে ডাস্টবিন স্থাপন করলেই হবে না, স্থানের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে সুপরিকল্পিত ভাবে কাজ করতে হবে। একই সাথে ওইসবের রক্ষণাবেক্ষণে এবং জনগণ নিয়ম মানছে কি-না তা দেখার ও অমান্যকারীর উপর জরিমানাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার সেটা হচ্ছে, যেহেতু এতোকিছু করা হচ্ছে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার জন্য, তাই মানুষকে নিয়ম মানতে হবে। শহরের সাংবাদিক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীগণ, পুলিশ প্রশাসন এবং জনগণ সচেতন হলে আমাদের শহর হয়ে উঠবে সুন্দর এবং মানুষের বসবাসের জন্য প্রকৃত অর্থে স্বাস্থ্যকর।
[লেখক : মোহাম্মদ আব্দুল হক, কলামিস্ট]
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ